গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার চরাঞ্চলের তিনটি ইউনিয়নে কোনো মাধ্যমিক স্কুল না থাকার খেসারত দিচ্ছে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ না হতেই শিক্ষার্থীদের নেমে পড়তে হচ্ছে জীবিকার তাগিদে জীবনযুদ্ধে। গজারিয়া ইউনিয়নের চর কটকগাছা গ্রামের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র আয়নাল মিয়া জানায়, ‘আমার বাবা গরিব মানুষ। বাইরে রেখে লেখাপড়া করাতে এত টাকা কোথায় পাবে বাবা। নদী পার হতে গিয়ে কখন কী হয়। এ কারণে বাবা বলেছে তোর পড়ার আর দরকার নাই।
আয়নালের মতো পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পরেই ঝরে পড়ছে চরাঞ্চলের বেশিরভাগ শিশু। এদের মধ্যে ছেলেরা নিয়োজিত হচ্ছে কৃষিকাজে আর মেয়েদের বসতে হচ্ছে বিয়ের পিঁড়িতে।
গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি, সাঘাটা, সুন্দরগঞ্জ ও সদর উপজেলার বুক চিড়ে বয়ে যাওয়া ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, যমুনায় জেগে ওঠা ছোট-বড় সব মিলে ১৬৫টি চর-দ্বীপচর রয়েছে । এসব চরে বসবাস করে প্রায় ৪ লাখ মানুষ। তাদের প্রধান পেশা কৃষি। কৃষির ওপর নির্ভর করেই খেয়ে-পরে বেঁচে থাকেন তারা।
গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার চরাঞ্চলের তিনটি ইউনিয়ন ফজলুপুর, এরেন্ডাবাড়ী ও ফুলছড়ি। এ ছাড়া কঞ্চিপাড়া, উড়িয়া, উদাখালী ও গজারিয়া ইউনিয়নের বেশ কিছু এলাকা চরাঞ্চলে হওয়ায় এখানকার শিক্ষার্থীরাও উচ্চ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এসব ইউনিয়নের বিশাল জনগোষ্ঠী কেবল শিক্ষাই নয়, বঞ্চিত সব রকমের সুযোগ-সুবিধা থেকে। ফলে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোতেই ঝরে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। এ অঞ্চলের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরই উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন থাকলেও ঝরে পড়ছে অকালে।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের তথ্য অনুযায়ী ফুলছড়ি উপজেলার চরাঞ্চলে ৭৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এ ছাড়াও নদীভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। চরাঞ্চল থেকে ৮০ ভাগ ছাত্রছাত্রী প্রাথমিকের গণ্ডি পাস করলেও অর্ধেকের বেশি ভর্তি হতে পারে না মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। চরাঞ্চলের শিক্ষার এই নিম্ন হারের কারণে উপজেলায় বাড়ছে দারিদ্র্য, বেকারত্ব, বাল্যবিয়ে ও শিশুশ্রম। যার বিরূপ প্রভাব পড়ছে জেলার সামগ্রিক শিক্ষা ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার ওপর।
চর কাবিলপুর গ্রামের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী রবিউল হাসান বলেন, ‘পড়তে তো ইচ্ছে করে; কিন্তু হামঘরে (আমাদের) চরে বড় স্কুল নাই। তাই বাবা কইচে আর পড়তে হবে না। তুই হামার সাথে খেতোত (জমিতে) কাম করবু। তখন থ্যাকা বাধ্য হয়া আব্বার সাথে জমিত কাজ করি।’
কালাসোনা চরের তিন সন্তানের জনক হবিবুর রহমান (৬০)। তিনি বলেন, ‘হামার দুই বেটা (ছেলে) আলাল ও দুলাল। ওরা দুজনেই ৫ ক্লাস পাস করিসে। ওর উপরে আরও কোনো স্কুল চরে না থাকায় দুই পোলা স্কুলে যাইতে পারে নাই। ওরা এখন কৃষিকাজে যুক্ত হয়েছে। আর মাইয়া হাবিবা খাতুন বাড়ির কাছে স্কুল থাকায় সে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ালেহা করছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘হাতের ওপর সংসার, ওদের যদি বড় স্কুলে ভর্তি করাই, তাহলে নদী পার হতে হবে, নৌকা ভাড়া লাগবে, দুপুরে খাওন দিতে হইব। মেলা খরচা হব, আমি একা কীভাবে সামলামু।’
এ ব্যাপারে জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার এনায়েত হোসেন বলেন, ‘চরাঞ্চলে মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। যে কয়টি বিদ্যালয় আছে তাও নদীতীর ঘেঁষে। আর যে চরগুলোতে মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করার উপযোগী, সেই চরগুলোর একটা তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। তালিকাটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে বলে জানান তিনি।
Leave a Reply