নারী জাগরণের অগ্রদূত মহীয়সী এই নারী ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ ইউনিয়নের খোর্দ মুরাদপুর গ্রামে এক জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। তিনি রোকেয়া খাতুন, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, মিসেস আর এস হোসেন নামেও লিখতেন এবং পরিচিত ছিলেন। ঊনবিংশ শতকে নারীরা যখন অবরোধবাসিনী, সেই সময়ে নারীর পরাধীনতার বিরুদ্ধে তিনি আওয়াজ তুলেছেন। অথচ মিঠাপুকুর উপজেলার ১৭টি ইউনিয়নের মধ্যে সবচেয়ে কম সংখ্যক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা রোকেয়ার জন্মভূমি এই পায়রাবন্দ ইউনিয়নে। এছাড়াও এই ইউনিয়নে এখনো রয়েছে বাল্য বিবাহের প্রবণতা।
মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ ইউনিয়নে নারী জাগরণের অগ্রদূত মহিয়সি নারী বেগম রোকেয়ার জন্মস্থান। কিন্তু পায়রাবন্দ ইউনিয়নের অভিরামনুরপুর, লহনী, লহনী কোনাপাড়া এমনকি বলদীপুকুর বাসষ্টান্ডে আজ অবধি কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় কিংবা মাধ্যমিক বিদ্যালয় গড়ে উঠেনি। একটি মাত্র স্কুলের অভাবে ০৩ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে বিদ্যালয় যেতে হয় কোমলমতি শিক্ষার্থীদের। শিশুদের দুরে স্কুলে পাঠিয়ে অভিভাবকদের থাকতে হয় নানান সংশয়ে। বিদ্যালয় না থাকায় নেই কোনো খেলার মাঠ কিংবা বিনোদন কেন্দ্র। স্কুল কলেজ না থাকায় এই তিন গ্রামের লোক শিক্ষার সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মিঠাপুকুর প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সুত্রে জানা গেছে, উপজেলায় মোট ২৭৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশী ইমাদপুর ইউনিয়ন রয়েছে ৩৩টি আর সবচেয়ে কম পায়রাবন্দ ইউনিয়নে ১৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে।
এই ইউনিয়নে রয়েছে বাল্যবিয়ের প্রবণতা। উপজেলার পায়রাবন্দ ইউনিয়নের খোর্দ্দ মুরাদপুর গ্রামে কিছুদিন আগে কফিল উদ্দিনের (ছদ্মনাম) কিশোরী মেয়ের বিয়ে হয়। সে স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী ছিল। কৈশোরের সম্ভাবনাময় সময়টাতেই তাকে সংসারের বোঝা মাথায় নিতে হয়েছে। অনেকটা তোড়জোড় করেই পরিবারের সদস্যরা কিশোরী মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেন। বাল্যবিয়ের এমন ঘটনা এ দেশে অপরিচিত কোনো ঘটনা না হলেও। এই ঘটনাটি গুরুত্বপূর্ণ একটি গ্রামের জন্য। কারণ এ গ্রামেই জন্ম বাঙালি মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার। সারাজীবন নারী মুক্তির জন্য কাজ করা বেগম রোকেয়া বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধেও ছিলেন সরব। তবে তার মৃত্যুর ৮৯ বছর পরও নিজ গ্রামেই হচ্ছে বাল্যবিয়ে। এমন পরিস্থিতিতেই বৃহস্পতিবার সারা দেশে পালিত হবে রোকেয়া দিবস।
বেগম রোকেয়ার ৮৯তম মৃত্যুবার্ষিকীতে এসেও পায়রাবন্দে বাল্যবিয়ে বন্ধ হয়নি। এতে চরম বিস্ময় প্রকাশ করেছেন রোকেয়া অনুরাগীরা। অনেকটা ক্ষোভ প্রকাশ করে রোকেয়া অনুরাগীরা বলেন, পায়রাবন্দে এখনও প্রকাশ্যে না হলেও গোপনে বাল্যবিয়ে হচ্ছে। মিঠাপুকুরের গুরুত্বপূর্ণ এই ইউনিয়নকে এখনও বাল্যবিয়ে মুক্ত করতে পারেনি স্থানীয় প্রশাসন।
পায়রাবন্দ বেগম রোকেয়া স্মৃতি মহাবিদ্যালয়ের কয়েজজন শিক্ষার্থী জানান, বেগম রোকেয়া নারীদের অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখিয়েছেন। যিনি এত লড়াই সংগ্রাম করেছেন, বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে ছিলেন অথচ আমাদের অনেক বান্ধবী বিবাহিত। হয়তো কারও অমতে, আবার কারও ফ্যামিলির চাপে বিয়ে হচ্ছে।
পায়রাবন্দ বাজার এলাকার মাসুম মিয়া বলেন, এখন আর বড় অনুষ্ঠান করে বাল্যবিয়ে হয় না। অনেক অভিভাবক হঠাৎ জানতে পারেন তাদের ছেলেমেয়েরা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে। তখন তাদের কিছুই করার থাকে না। তবে আগের মতো ঢাকঢোল পিটিয়ে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের বিয়ে হয় না।
পায়রাবন্দ ইউনিয়নের কাজী আনছারুল ইসলাম জানান, গত এক বছরে ২৫ থেকে ৩০টি বাল্যবিয়ের রেজিস্ট্রি না করেই আমি ফেরত এসেছি, কারণ মেয়ের বয়স হয়নি। পরে খোঁজ নিয়ে শুনি তাদের বিয়ে হয়েছে। কে বিয়ে পড়ালো, আর কিভাবে বিয়ে রেজিস্ট্রি হলো তা জানিনা। তবে তাদের বিয়ে হয়েছে শুনেছি।
পাইকান উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বদিউজ্জামান জানান, করোনাকালে অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে, অনেক মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হওয়ার কারণে সংবাদ আসে যে দু-চারজনের বিয়ে হয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের কিছুই করার থাকে না, এক্ষেত্রে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। আমরা ক্লাসে এবং বাইরে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মোটিভেশন দেই, যাতে বাল্যবিয়ে না হয়।
বেগম রোকেয়া মেমোরিয়াল বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাইদুল ইসলাম বলেন, আমার বিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রীর গোপনে বিয়ে হয়েছে। এসব বিয়ে রংপুরে হয় না। রংপুর বা পায়রাবন্দের বাইরে অন্য কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে হয়। আমরা বাল্যবিয়ের বিষয়ে জানতে পেরেও কিছু বলার বা করার থাকে না। তবে আগের তুলনায় বাল্যবিয়ে অনেকটা কমেছে।
মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফাতেমাতুজ জোহরা জানান, আমরা বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে স্কুল-কলেজসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোত সচেতনতামূলক কাজ করছি। বাল্যবিয়ে বন্ধে প্রশাসন কাজ করছে, এক্ষেত্রে অভিভাবক ও স্থানীয়দের সচেতনতার পাশাপাশি সহযোগিতা প্রয়োজন। এছাড়াও উপজেলার সব ইমাম, মুয়াজ্জিন, বিবাহ রেজিস্ট্রারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে বৈঠক করেছি। আমরা কাজ করছি। আশা করছি ফল পাব।
রোকেয়া দিবসে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের আয়োজন
বেগম রোকেয়ার ১৪১তম জন্ম ও ৮৯তম মৃত্যু দিবসে নানা কর্মসূচি নিয়েছে রংপুর জেলা ও উপজেলা প্রশাসন। এর মধ্যে রয়েছে বেলা ১১টায় বেগম রোকেয়া স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পমাল্য অর্পণ ও দিবস উদ্বোধন, বেলা সাড়ে ১১টায় আলোচনা সভা, দুপুর সাড়ে ১২টায় নারীর প্রতি সহিংসতা ও বাল্যবিয়ে রোধ সম্পর্কিত সেমিনার, পুরস্কার ও পদক বিতরণ আর দুপুর ১টায় মিলাদ ও দোয়া মাহফিল। বিকেল সাড়ে ৩টায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শেষ হবে দিবসের আয়োজন।
Leave a Reply