আল্লাহতায়ালা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন সুগঠিত দেহ দিয়ে। এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে ইরশাদ করেন, ‘আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি অতি উত্তম আকার আকৃতি দিয়ে।’ সুরা ত্বীন : ৩
মানুষের সুন্দর-সুগঠিত দেহ নানা কারণে অসুস্থ হয়। তখন আমরা দেহের চিকিৎসা করতে ব্যস্ত হয়ে যাই। কারণ চিকিৎসা না করালে যে সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকা যায় না। যে কারণে ধনী-গরিব সব মানুষ অসুস্থ হলে সুস্থ হওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। শরীরের অসুস্থতার পাশাপাশি মানুষের একটা কলব (আত্মা) আছে। সেটাও কখনো কখনো অসুস্থ হয়। সেটারও চিকিৎসা দরকার, যতœ দরকার। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘প্রত্যেক রোগেরই চিকিৎসা আছে। আল্লাহ এমন কোনো রোগ পাঠাননি যেটার চিকিৎসা তিনি দেননি।’
আমাদের রোগাক্রান্ত কলবেরও চিকিৎসা আছে। সেটা যদি ঠিক থাকে তাহলে সব ঠিক থাকবে। আমরা এ কথাটি জানতে পারি নবী কারিম (সা.)-এর কাছে। তিনি বলেন, ‘জেনে রাখো, শরীরের মধ্যে একটি মাংসপিণ্ড আছে, তা যখন ঠিক হয়ে যায়, গোটা শরীর তখন ঠিক হয়ে যায়। আর তা যখন খারাপ হয়ে যায়, গোটা শরীর তখন খারাপ হয়ে যায়। জেনে রাখো, সে গোশতের টুকরোটি হলো কলব।’ সহিহ্ বোখারি : ৫২
কলব অর্থ হৃদয় বা অন্তর। কলব সম্পর্কে কোরআনে কারিমে অনেকগুলো আয়াত আছে। ওই সব আয়াতে কলবের ক্রিয়াকলাপ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তাদের কলবগুলোতে রোগ আছে।’ সুরা বাকারা : ১০
রোগাক্রান্ত কলবের ক্ষতি কেমন সেটা কোরআনে কারিমে আল্লাহতায়ালা উল্লেখ করেছেন। ‘তাদের কলব রয়েছে, কিন্তু তারা তা দ্বারা বোঝে না।’ সুরা আরাফ : ১৭৯
তার মানে অসুস্থ-রোগাক্রান্ত অন্তরের অধিকারী ব্যক্তির পক্ষে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ, দ্বীনের বিধি-বিধান বোঝা সম্ভব নয়। অনুধাবন করা সম্ভব নয় সত্যকে। সে ব্যক্তির সঙ্গে আল্লাহ একই আয়াতে পশুর সাদৃশ্য উল্লেখ করেছেন। এভাবে যদি কলব অসুস্থ হয়ে যায়, নষ্ট হয়ে পড়ে; তখন ধীরে ধীরে মানুষের সামগ্রিক সত্তা নষ্ট হয়ে যায়, মানুষ হয়ে যায় পশুর চেয়েও অধম।
পাপের পরিণতিতে মানুষের রুহ এবং দেহ অসুস্থ হয়, অন্তর হয় অশান্ত। আমরা আল্লাহর অবাধ্যতার কাজ করতে থাকি হররোজ। এ প্রসঙ্গে ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, ‘শরীরের রোগ থেকে অন্তরের রোগগুলো আরও কঠিন। কারণ শারীরিক রোগ মানুষকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করে। কিন্তু অন্তরের রোগ মানুষকে অনন্তকালের দুর্ভাগ্যের (জাহান্নামের) দিকে নিয়ে যায়।’ মিফতাহু দারিস সায়াদাহ : ১/৩০৬
অন্তরের রোগ কী কী? মুসলিম বিশ্বের অন্যতম স্কলার শায়খ সালিহ আল মুনাজ্জিদের রচিত কিতাবে অন্তরের রোগ হিসেবে যেগুলো উঠে এসেছে। সেগুলো হলো প্রবৃত্তির অনুসরণ, দুনিয়ার ভালোবাসা, মুনাফিকি, মাখলুকের প্রেমাসক্তি, গাফিলতি, ঝগড়া-বিবাদ, অহংকার ও নেতৃত্বের লোভ। এছাড়া যেসব বিষয় হৃদয়কে কলুষিত করে, অন্তরকে নষ্ট করে বলে ইমাম ইবনে তাইমিয়া তার তিব্বুল কুলুব গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন তা হচ্ছে হিংসা, ঘৃণা-বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা, প্রদর্শনেচ্ছা, অন্যকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যসহ ইত্যাদি। এগুলো রোগগ্রস্ত কলবের নমুনা। এসব কারণে অন্তরের শান্তি হারিয়ে যায়। হৃদয় প্রশান্তিহীন অস্থির হয়ে পড়ে। হৃদয়-মনে সবসময় অস্থিরতা বিরাজ করে।
সাহাবি হজরত জারিব ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, প্রতিটি ব্যাধিরই প্রতিকার রয়েছে। অতএব রোগে যথাযথ ওষুধ প্রয়োগ করা হলে আল্লাহর ইচ্ছায় আরোগ্য লাভ হয়। সহিহ্ মুসলিম : ৫৫৫৩
সে হিসেবে কলবের রোগগুলোরও চিকিৎসা আছে। সে অনুযায়ী চললে পাপগ্রস্ত অশান্ত অসুস্থ কলবকেও সুস্থ করা, শান্ত-স্থির করা সম্ভব। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর স্মরণেই অন্তর প্রশান্ত হয়।’ সুরা রাদ : ২৮
আল্লাহর স্মরণের উপকারিতা এবং রোগাক্রান্ত অন্তরের চিকিৎসা সম্পর্কে হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার প্রভুর স্মরণ করে আর যে করে না তাদের উদাহরণ হলো, জীবিত এবং মৃত ব্যক্তির ন্যায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি প্রতিদিন একশ বার সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী পাঠ করবে, তার পাপ যদি সমুদ্রের ফেনার সমতুল্য হয়, তবুও আল্লাহ দয়া করে তা ক্ষমা করে দেবেন।’ সহিহ্ বোখারি : ৬৪০৫-০৭
হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি দিনে একশ বার লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকালাহু, লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু ওয়াহুয়া আলা কুল্লি শাইয়্যিন কাদির পড়ে সে ব্যক্তি দশটি দাস স্বাধীন করার সওয়াব পাবে, তার জন্য একশটি নেকি লেখা হবে এবং তার একশটি গোনাহ মিটিয়ে দেওয়া হবে। ওই দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত শয়তান থেকে তার রক্ষা পাওয়ার ব্যবস্থা হবে এবং তার চেয়ে উত্তম আর কেউ হবে না।’ সহিহ্ বোখারি : ৬৪০৩
এভাবে আমরা যদি কলবকে আল্লাহর জিকিরে ব্যস্ত রাখতে পারি, তাহলে ইনশাআল্লাহ কোনো ধরনের রোগ বাসা বাঁধবে না। কোনো রোগ (পাপ) যদি আঘাত করে, আক্রমণ করতে আসে, তখন সে রোগ স্থায়ী হতে পারবে না। আত্মাকে আখেরাতে আজাবের মুখোমুখি হতে হবে না। অন্তর পরিশুদ্ধ করার মাধ্যমে আত্মার যতœ নেওয়া সম্ভব হবে।
অন্তরের রোগ ও সুস্থতা সম্পর্কে ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) একটি চমৎকার দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘কলবকে অসুস্থতা থেকে সুস্থতায় পরিণত করা কেবল ইলমের মাধ্যমেই সম্ভব। তাই তো আল্লাহ তার কিতাবের নাম দিয়েছেন অন্তরের রোগগুলোর সুস্থতা। আর এ কারণেই শরীরের চিকিৎসক ডাক্তারেরা আর অন্তরের চিকিৎসক আলেমরা।’ মিফতাহু দারিস সায়াদাহ : ১/৩০৫
ইবনে তাইমিয়া (রহ.)-এর কথা থেকে কোরআনের ইলম অর্জন আর আলেম-উলামাদের সান্নিধ্যে থাকার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা যায়। এ উপলব্ধি থেকে খাঁটি মুমিন-মুসলমান হিসেবে দেহের যতœ নেওয়ার পাশাপাশি অন্তরের যতœ নিতে হবে। আল্লাহর রাসুল (সা.) যেভাবে যত্ন নেওয়ার, চিকিৎসার পদ্ধতি বাতলে দিয়েছেন, পূর্ববর্তী বুজুর্গরা আল্লাহ-রাসুলের নির্দেশনার মধ্যে থেকে যে পন্থাগুলো আমাদের বাতলে দিয়েছেন, আমরা যদি সেভাবে নিজের অন্তরের যত্ন নিতে পারি তাহলে আমাদের অন্তর বিশুদ্ধ থাকবে। আমরা কাজে-কর্মে গতি পাব। পাপমুক্ত থাকতে পারব। হতে পারব জান্নাতের বাসিন্দা।
Leave a Reply