পরিস্থিতি সংকটময় হয়ে ওঠে যখন রাষ্ট্র কোনো অপরাধ করে। যার হাতে আছে সম্পদ ও অস্ত্র। যা কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের হাতে নেই। তাহলে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয়ে যেসব অপরাধ হয় তার সমাধান কী? এ ক্ষেত্রে একদল আত্মমর্যাদাশীল লোকের সন্ধান পাওয়া যায়, যারা অন্যায়ের প্রতিবাদে দাঁড়িয়ে যায় এবং এদিকে ভ্রুক্ষেপ করে না যে অপরাধী কে এবং তার শক্তি কত! এ বিষয়ে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর সূত্রে সহিহ মুসলিমের একটি হাদিস উদ্ধৃত করা হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমার আগে আল্লাহ তাআলা যে নবীকেই পাঠিয়েছেন, তাদের মধ্যে তাঁর জন্য একদল অনুসারী ও সহাবা ছিল। তারা তাঁর সুন্নতকে সমুন্নত রাখত এবং তাঁর নির্দেশের অনুসরণ করত। অতঃপর তাদের অবর্তমানে কতগুলো মন্দ লোক স্থলাভিষিক্ত হয়। তারা মুখে যা বলে নিজেরা তা করে না। আর যা করে তার জন্য তাদের নির্দেশ করা হয়নি। অতএব যে ব্যক্তি তাদের হাত (শক্তি) দ্বারা মোকাবেলা করবে, সে মুমিন মুখে প্রতিবাদ করবে সে মুমিন, যে অন্তরে প্রতিহত করার ইচ্ছা রাখে সে মুমিন। এরপর আর সরিষার দানা পরিমাণও ঈমানের স্তর নেই।’ (মুসলিম, হাদিস : ৮৩)
তাদের দাবি, হাদিসে ক্ষমতাসীনদের অন্যায়ের প্রতিবাদে উম্মতের শীর্ষ ব্যক্তিদের শক্তি প্রয়োগের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
হাদিসের গ্রহণযোগ্যতা : আল্লামা ইবনে রজব (রহ.) বলেন, ইমাম আহমদ (রহ.) হাদিসটি অস্বীকার করেছেন ইমাম আবু দাউদের বর্ণনায়। তিনি বলেন, হাদিসটি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর এমন বহু হাদিসের বিপরীত, যেখানে রাষ্ট্রপ্রধানদের অন্যায়ের প্রতিবাদে ধৈর্য ধারণের নির্দেশ দিয়েছেন।
হাদিসের ব্যাখ্যা : হাত দ্বারা পরিবর্তনের অর্থ জিহাদ বা চূড়ান্ত শক্তি প্রয়োগ নয়। ইমাম আহমদ (রহ.) বলেন, হাত দ্বারা পরিবর্তনের অর্থ তরবারি বা অস্ত্র নয়। সুতরাং উম্মতের নেতৃস্থানীয়দের হাত দ্বারা অন্যায়ের প্রতিবাদের অর্থ হবে—হাত দ্বারা অন্যায় উপকরণগুলো দূর করে দেওয়া। যেমন—তাদের মদগুলো ঢেলে দেওয়া, যেসব যন্ত্র-উপকরণ মানুষকে আল্লাহবিমুখ করে তা ভেঙে দেওয়া ইত্যাদি। অথবা সামর্থ্য থাকলে শাসকের অন্যায় নির্দেশগুলো প্রতিহত করা। এ পর্যন্ত করা বৈধ। এটা সশস্ত্র জিহাদের অন্তর্ভুক্ত নয় এবং অপরাধী রাষ্ট্রপ্রধানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহও নয়। এই সংযম প্রদর্শন করতে হবে। কেননা, একাকী বা ছোট প্রতিবাদী দল অস্ত্র তুলে নিলে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ার ভয় আছে, যা নিরপরাধ মুসলিমদের জীবননাশের কারণ হয়ে উঠবে। ফুদাইল ইবনে ইয়াজসহ অন্যরা এমনটি বলেছেন।
এ ছাড়া যখন এই আশঙ্কা প্রবল হয় যে আমি প্রতিবাদ করলে রাষ্ট্র আমাকে হত্যা করতে পারে, আমার প্রতি জুলুম হতে পারে, আমাকে বন্দি করা হতে পারে, জেলে পাঠাতে পারে, দেশান্তর করতে পারে, আমার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে পারে অথবা এমন ভয়াবহ কষ্টের মুখোমুখি হতে পারি, তখন তার ওপর থেকে ‘সত্কাজের আদেশ ও অসত্কাজ থেকে নিষেধ’ করার দায়িত্ব রহিত হয়। এ বিষয়ে পূর্বসূরি আলেমদের সুস্পষ্ট মতামত আছে।
সংঘাতের ব্যাপারে আলেমদের হুঁশিয়ারি : রাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘাতে জাড়ানোর ব্যাপারে পূর্ববর্তী ইমাম ও মুজতাহিদরা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। যেমন—ইমাম আহমদ (রহ.) বলেন, শাসকের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হয়ো না। কেননা তাঁর তরবারি অত্যন্ত ধারালো। তবে শাসকদের পক্ষ থেকে নিছক কষ্ট ও বলপ্রয়োগের ভয় থাকলে প্রতিবাদ থেকে সরে না আসাই উত্তম। এ বিষয়ে (সম্ভবত জেলে বন্দি থাকাকালীন) ইমাম আহমদ (রহ.)-কে বলা হয়—নবী (সা.) থেকে কি বর্ণিত হয়নি যে মুমিনের জন্য নিজেকে অপদস্থ করা বৈধ নয়। অর্থাৎ নিজেকে এমন কষ্টের মধ্যে ফেলে দেওয়া, যা থেকে পরিত্রাণের উপায় তার নেই। তিনি জবাব দিলেন, এটা সে অর্থে নয়। নিম্নোক্ত হাদিস দ্বারা সম্ভবত এটাই বোঝা যায়। মহানবী (সা.) বলেন, ‘সর্বোত্তম জিহাদ হলো অত্যাচারী শাসকের সামনে সত্য উচ্চারণ করা।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৪৩৪৪)
জনসচেতনতায় থামবে রাষ্ট্রীয় অন্যায় : এতক্ষণ যা নিয়ে আলোচনা হলো সেটা শাসকের ব্যক্তিগতভাবে বা তার কাছের লোকেরা পাপে লিপ্ত হয়। কিন্তু যখন রাষ্ট্রযন্ত্রকে অপরাধে নিয়োজিত করা হয়, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করা হয়, তাতে প্রতিফলিত হয় চিন্তাগত, আইনগত, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও চারিত্রিক মূল্যবোধের বিকৃতি, তখন তা পরিবর্তনের সাধ্য কোনো এক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর থাকে না। কেননা, তখন অপরাধ মদপান ও গানের আসরে সীমাবদ্ধ থাকে না, তখন তা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ে, তা কেন্দ্র করে নতুন মতবাদ গড়ে ওঠে, মানুষ তার আনুগত্য করে, তা রক্ষার জন্য আইন করা হয় এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে তার প্রহরী নিযুক্ত করা হয়। আর এত কিছুর মোকাবেলা করা কোনো ব্যক্তি বা ক্ষুদ্র সংগঠনের পক্ষে সম্ভব নয়; বরং তা পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন পাল্টা ব্যবস্থা গড়ে তোলা, নতুন জীবনধারার প্রসার ঘটানো এবং জনগণকে নতুন জীবনদর্শন দান করা।
ফিকহুল জিহাদ থেকে মো. আবদুল মজিদ মোল্লার ভাষান্তর
Leave a Reply