নবীজি (সা.) মদিনায় আগমনের আগে তাঁর নাম ছিল ‘ইয়াসরিব’ বা রোগাক্রান্ত। ইয়াসরিব নামকরণের পেছনে নানাবিধ ঐতিহাসিক যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায়। মহানবী (সা.)-এর আগমনের আগে মদিনার রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক কাঠামোতে স্থিতি ও ভারসাম্য ছিল না। বরং সর্বগ্রাসী নৈরাজ্য তাঁকে একটি ‘রোগগ্রস্ত’ পবিত্র কোরআনের একটি আয়াতে মদিনার তৎকালীন সামাজিক অবস্থার ধারণা পাওয়া যায়। ইরশাদ হয়েছে, ‘স্মরণ কোরো! তোমাদের আল্লাহর অনুগ্রহ। যখন তোমরা ছিলে পরস্পরের শত্রু। অতঃপর আল্লাহ তোমাদের অন্তরে হৃদ্যতা তৈরি করেছেন। ফলে আল্লাহর অনুগ্রহে তোমরা ভাই ভাইয়ে পরিণত হয়েছ। আর তোমরা ছিলে অগ্নি গহ্বরের প্রান্ত সীমায়। আল্লাহ তোমাদের তা থেকে রক্ষা করেছেন। এভাবে আল্লাহ তোমাদের সামনে তাঁর নিদর্শনাবলি বর্ণনা করেন, যেন তোমরা সুপথ লাভ করো।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১০৩)
ধর্মীয় অবস্থা : রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আগমনের আগে ধর্মীয় বিশ্বাসের বিবেচনায় মদিনাবাসী দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। এক. ইহুদি, দুই. মুশরিক। মদিনার ইহুদিরা ৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাট দ্বারা বিতাড়িত হয়ে মদিনায় আশ্রয় নিয়েছিল। প্রকৃত দ্বিন ও আসমানি কিতাবের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক খুব ক্ষীণ হয়ে এলেও তাদের ভেতর ধর্মচর্চা ছিল। ইবাদত ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন করত এবং তাদের শিক্ষাব্যবস্থাও ছিল ধর্মভিত্তিক। তাদের ভেতর জাদুবিদ্যা ও গণনা শাস্ত্রের ব্যাপক চর্চা ছিল।
অন্যদিকে মদিনার মুশরিকরা মক্কাকে তাদের ধর্মীয় কেন্দ্র মনে করত। মক্কার মুশরিকরা যেসব দেবীর উপাসনা করত এবং যেসব প্রতিমাকে স্বীকৃতি দিয়েছিল মদিনাবাসীও তাদের উপাসনা করত এবং তা ঘরে রাখত। ‘মানাত’ ছিল মদিনার সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রতিমা। মক্কা ও মদিনার মধ্যবর্তী ‘কুদাইদ’ উপত্যকায় মানাতের মূর্তি স্থাপন করা হয়েছিল। তবে পূজা-আর্চনা ও ধর্মীয় প্রভাব বিস্তারে মদিনার মুশরিকদের অবস্থান ছিল মক্কাবাসীর পরেই।
রাজনৈতিক অবস্থা : মদিনার অধিবাসীদের সবাই ছিল বহিরাগত। ইহুদিরা এসেছিল ফিলিস্তিন থেকে, আর মুশরিক তথা আউস ও খাজরাজরা এসেছিল ইয়ামেন থেকে। রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় আগমন করা পর্যন্ত ইহুদিদের ওপর আরব পৌত্তলিকদের প্রাধান্য বজায় ছিল। মদিনায় ইহুদিদের তিনটি গোত্র বাস করত : বনু কায়নুকা, বনু নাজির ও বনু কুরায়জা। ধর্মে সবাই ইহুদি হলেও তাদের ভেতর বিরোধ ছিল অত্যন্ত প্রবল। তারা পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হতো এবং সুযোগ পেলে বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করত। শুধু তা-ই নয়, এক গোত্র অপর গোত্রের বিরুদ্ধে শত্রুদের সহযোগিতা করত। পবিত্র কোরআনে তাদের রাজনৈতিক বিরোধ এভাবে চিত্রিত হয়েছে—‘যখন আমি তোমাদের অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলাম যে তোমরা পরস্পর রক্তপাত কোরো না, তোমরা নিজেদের বসত (স্বদেশ) থেকে বের করে দেবে না। তোমরা তা স্বীকার করেছিলে এবং তোমরা তার সাক্ষী। অতঃপর তোমরাই তারা, যারা পরস্পরকে হত্যা করছ এবং তোমাদের একদল অপর দলকে তোমাদের বসত থেকে বের করে দিয়েছ। তোমরা নিজেরা তাদের বিরুদ্ধে অন্যায় ও সীমা লঙ্ঘন করে পরস্পরের পৃষ্ঠপোষকতা করেছ এবং তারা যখন বন্দিরূপে তোমাদের কাছে উপস্থিত হয়, তখন তোমরা মুক্তিপণ দাও। অথচ তাদের বহিষ্কারই তোমাদের জন্য অবৈধ ছিল।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ৮৪-৮৫)
আউস ও খাজরাজ ছিল ইয়ামেনের আজদ গোত্রের একটি শাখা। মাআরিব বাঁধ ধ্বংস হওয়ার পর ইয়ামেনে কৃষি জমিতে সেচ দেওয়ার মতো পানির সংকট, আবিসিনিয়ার হামলা, খরা-দুর্ভিক্ষের মতো প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিক দুর্যোগের মুখে তারা মদিনায় আশ্রয় নিয়েছিল। ইহুদিদের মতো আউস ও খাজরাজ অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিল। ইহুদিরা তাদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব আরো উসকে দিত। পর্দার অন্তরালে থেকে একদলের বিরুদ্ধে অপর দলকে সহযোগিতা করত। ইসলাম আগমনের আগে আউস ও খাজরাজের মধ্যে একাধিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তাদের প্রথম যুদ্ধ ছিল সুমায়ের এবং শেষ যুদ্ধ ছিল বুয়াস। অন্তর্দ্বন্দ্ব ও কলহের কারণে রাজনৈতিকভাবে মদিনা রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারেনি। অথচ মদিনার ভৌগোলিক অবস্থান, উর্বর ভূমি ও মদিনাবাসীর সাহসিকতা একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। মদিনার রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নৈরাজ্যের প্রমাণ বহন করে এখনো টিকে আছে তৎকালীন ‘আতম’ বা ছোট দুর্গগুলো। যাতে তারা প্রয়োজনীয় খাদ্য, পানীয়, অস্ত্র ও রসদ সংরক্ষণ করত।
অর্থনৈতিক অবস্থা : মদিনার অর্থনীতি মক্কার মতো বাণিজ্যনির্ভর ছিল না। মদিনার অর্থনীতিতে কৃষিরও উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। খেজুর ছিল মদিনার সবচেয়ে অর্থকরী ফসল। খেজুর যেমন মদিনার খাদ্য ঘাটতি পূরণ করত, তেমন তা শিল্পসামগ্রী নির্মাণ, জ্বালানি ও পশুপালের খাবার হিসেবেও কাজে আসত। খেজুর ছাড়াও মদিনায় যব, গম, শাক-সবজি ও ফলমূল উৎপন্ন হতো। প্রচুর ফসল উৎপন্ন হলেও মদিনা খাদ্যে স্বনির্ভর ছিল না। শাম থেকে তাদের খাদ্য আমদানি করতে হতো। মদিনাবাসী উট, বকরি, ঘোড়া ও গরু পালন করত। কৃষিকাজে উট ব্যবহার করত। মদিনায় কয়েকটি বাজারও ছিল। সবচেয়ে প্রসিদ্ধ বাজার ছিল বনু কায়নুকার বাজার। সেখানে স্বর্ণ, রৌপ্য, আতর, মেশক, সুতি ও রেশমি কাপড়, রঙিন গালিচা ও নকশাকৃত পর্দা বিক্রি হতো।
মদিনার অর্থনীতিতে ইহুদিদের প্রাধান্য ছিল। নগদ অর্থ, ধন-সম্পদ ও স্বর্ণ-রৌপ্য তাদের কাছেই বেশি থাকত। অন্যদিকে আরব মুশরিকদের অংশগ্রহণ বেশি ছিল কৃষি কাজে। অপরাপর জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের বেশির ভাগ আর্থিক সম্পর্ক ছিল বন্ধক ও সুদভিত্তিক। কেননা কৃষকদের কৃষিকাজের জন্য ঋণের প্রয়োজন হতো। বন্ধক হিসেবে ইহুদিরা শুধু মূল্যবান জিনিসপত্র ও স্থাবর সম্পদ রাখত না; বরং তারা নারী ও শিশুদেরও বন্ধক হিসেবে রাখত। সহিহ বুখারির একটি বর্ণনায় মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা (রা.)-এর সঙ্গে কাব ইবনে আশরাফের এক কথোপকথনে বিষয়টি স্পষ্ট হয়। (যুদ্ধ অধ্যায়)
মদিনার অর্থনৈতিক আধিপত্য বজায় রাখতে ইহুদিরা আউস ও খাজরাজ গোত্রকে যুদ্ধে লিপ্ত রাখার চেষ্টা করত। এ জন্য তারা প্রচুর অর্থবিত্তও ব্যয় করত।
সাংস্কৃতিক অবস্থা : মদিনাবাসী সাংস্কৃতিক দিক থেকেও বেশ রুচিশীল ছিল। সেখানে দোতলা বাড়ি নির্মাণ শুরু হয়েছিল। বসার জন্য চেয়ার, সিসা ও পাথরের পেয়ালা, নানা ধরনের প্রদীপ, কৃষিকাজের জন্য টুকরি ও থলি ব্যবহৃত হতো। মেয়েরা কংকন, বাজুবন্ধ, পায়ের মল, খাড়ু, কানাবালা, আংটি, হার ইত্যাদি ব্যবহার করত। মেয়েদের মধ্যে কাপড় বোনা, সুতা কাটা, সেলাই করা, রং করা, পাথর কাটার প্রচলন ছিল। এ ছাড়া মদিনাবাসী বছরে দুইবার খেলাধুলা ও আনন্দ-উৎসবে কাটাত। মদিনার ইহুদিদের ধর্মভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থাও ছিল। আরবরা ছিল কিছুটা স্বাধীন ও যাযাবর জীবনে অভ্যস্ত।
তথ্যঋণ : নবীয়ে রহমত
Leave a Reply