খাজা ময়েনউদ্দিন চিশতি. কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি :
কুড়িগ্রামের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। ধরলার পানি সেতু পয়েন্টে বিপৎসীমার ৬২ সেন্টিমিটার ও ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে বিপৎসীমার ৪০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে করে এই দুই নদ-নদীর অববাহিকার দুই শতাধিক চরাঞ্চলের লক্ষাধিকেরও বেশি মানুষ পানিবন্দি জীবন-যাপন করছে। এ অবস্থায় সবচেয়ে বেশি বিপাকে পাড়েছে ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার অববাহিকায় জেগে উঠা নতুন চরে বসত গড়া মানুষজন। ১৫ দিনেরও বেশি সময় ধরে এসব চরের মানুষ পানিবন্দি জীবন-যাপন করায় দেখা দিয়েছে খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, শিশু খাদ্য ও গো-খাদ্যের সংকট। দীর্ঘ সময় পানিতে অবস্থান করায় হাতে পায়ে ঘাসহ অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন পানি বাহিত রোগে।
সরেজমিনে কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বেগমগন্জ ইউনিয়নের দক্ষিন বালাডোবার চরে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে প্রায় শতাধিক পরিবারের বাড়ির ঘরের অর্ধেক পর্যন্ত পানিতে তলিয়ে আছে। এরমধ্যে ১০ থেকে ১২টি পরিবার ঘর-বাড়ি ছেড়ে আত্মীয়ের বাড়ি ও উঁচু জায়গায় স্থান নিলেও বাকী পরিবারগুলো নৌকায় ও ঘরের ভিতর উঁচু করা মাচানে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েসহ পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করছে।
সেখানে নৌকা দেখে ত্রাণের আশায় ছুটে আশা মানুষজন জানান, প্রায় ১৫ দিনেরও বেশি সময় ধরে এই চরের মানুষ পানিবন্দি হয়ে কষ্টে দিন যাপন করলেও এখন পর্যন্ত সবার বেশির ভাগ পরিবার সরকারী বা বেসরকারী খাদ্য সহায়তা পায়নি। হাতে কাজ না থাকায় খাদ্য সংকটে পড়েছেন এসব চরের শ্রমজীবিরা।
উলিপুরের বেগমগন্জ ইউনিয়নের দক্ষিন বালাডোবার চরের বন্যা কবলিত হাজেরা বেগম (৪০) জানান, এবারের বন্যার পানিতে তার ঘরের অর্ধেক তলিয়ে গেছে। বাড়ির পাশে বড় নৌকা আসতে দেখেই শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে একবুক পানি মারিয়ে নৌকার নিকট ছুটে এসেছেন তিনি। সরকারী কোন সহায়তা পেয়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত কোন সহায়তা পাইনি। ঠিক মতো রান্না করতে পারছি না। খেয়ে না খেয়ে দিন পাড় করছি।
হাজেরা বেগমের মতোই একে একে শিশু সন্তানদের কোলে নিয়ে বুক পানি পেরিয়ে নৌকার কাছে ছুটে আসেন হাবিজা, হাজেরা, আমেনাসহ আরো ১০ থেকে ১২ জন মহিলা। বালাডোবার চরের বাসিন্দা তারাও।
তাদের সাথে কথা হলে জানান, ত্রাণের নৌকা ভেবে ছুটে এসেছেন তারাও। কিন্তু ত্রাণের নৌকা না হয়ে সাংবাদিকদের নৌকা দেখে কিছুটা হতাশ হওয়ার কথাও জানান তারা।
দক্ষিন বালাডোবা চরের জুলেখা বেগম জানান, গত প্রায় ১৫ দিনেরও বেশি সময় ধরে ঘরে একবুক পানি। ঘরের মাচান উঁচু করে সেখানে রাত কাটান আর দিনে নৌকা অথবা বুক পানিতে। এ অবস্থায় ঠিক মতো রান্না বারাও করতে পারছেন না তিনি। তিন সন্তানসহ পাঁচ জনের পরিবার চলছে খেয়ে না খেয়ে। বন্যার পানিতে চরাঞ্চল তলিয়ে থাকায় দিনমজুরের কাজ বন্ধ রয়েছে তার স্বামীর। এখন পর্যন্ত সরকারী বা বেসরকারী কোন সহায়তাও পাননি তারা।
দক্ষিন বালাডোবার চরের মকবুল হোসেন জানান, চরাঞ্চল তলিয়ে থাকায় দিনমজুরী বন্ধ হয়ে গেছে। হাতে টাকা পয়সা নেই। হাটবাজার যেতে পারছি না। ঠিকমত রান্না করতে না পারায় ছেলে-মেয়েদেরও ভালোভাবে খাওয়াতে পারছি না। এই চরের প্রায় শতাধিক পরিবারের বাড়ির ঘরের অর্ধেক পর্যন্ত পানিতে তলিয়ে আছে। বন্যা কবলিত হওয়ার ১৫ দিন পার হলেও শনিবার ১০ কেজি করে চাল দেয়া হয়েছে। কিন্তু সে চালও সবার ভাগ্যে জোটেনি। এই মুহুর্তে শুকনো খাবারের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বলে জানান তিনি।
একই ইউনিয়নের পার্শ্ববর্তী মশালের চরে নৌকায় বসে দিন কাটানো রুপবান(৫০) এর সাথে কথা হলে তিনি জানান, নিজেরা কষ্ট করে খেলেও শিশু বাচ্চাকে ঠিক মতো খাওয়াতেও পারছেন না তিনি। পার্শ্ববর্তী কোন উঁচু জায়গা না থাকায় ঘর-বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতেও পারছেন না তিনি। ঘরের ভিতর উঁচু করা চুলায় দিনে একবেলা রান্না করে তা খেয়েই দিন চলছে তাদের।
বন্যা কবলিত চরাঞ্চলগুলো ঘরে দেখা গেছে, দ্রুত পানি নেমে গেলে কষ্ট কিছুটা হলেও কমবে পারিবারগুলোর। আর যদি পানি আরো দীর্ঘ সময় অবস্থান করে তাহলে অবর্ণনিয় কষ্ট ভোগ করতে হবে তাদের।
এ ব্যাপারে উলিপুর উপজেলার বেগমগন্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বেলাল হোসেন জানান, আমার ইউনিয়নের ২ হাজার পরিবার পানিবন্দি। বরাদ্দ পেয়েছি ৫ মেট্রিক টন চাল। যা ১০ কেজি করে ৫শ পরিবারের মাঝে শনিবার সকাল থেকে বিতরণ করা হচ্ছে।
প্রায় ১৫ দিনেরও বেশি সময় ধরে ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় বেগমগন্জের মতো অবস্থা উলিপুর, চিলমারী, রৌমারী, রাজিবপুর ও সদর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছে ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার অববাহিকার নতুন জেগে উঠা অন্তত: শতাধিক চরের পানিবন্দি মানুষ। নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়ে নতুন চরে বাড়ি করা পরিবারগুলোর একই অবস্থা। চলমান বন্যায় জেলার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের প্রায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি জীবন-যাপন করছে।
সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো: আইয়ুব আলী সরকার জানান, আমার ইউনিয়নের পানিবন্দি আড়াই হাজার পরিবারের চাহিদা পাঠিয়েছি। এরমধ্যে ৫ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ পেয়েছি যা বন্যা কবলিতদের তালিকা করে বেশি ক্ষতিগ্রস্থদের মাঝে বিতরণ করা হচ্ছে।
কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম জানান, বন্যার্তদের জন্য ২৮০ মেট্রিক টন চাল ও সাড়ে ১২ লাখ টাকা বিতরণের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। নতুন করে আরো ১৫শ প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ পাওয়া গেছে যা বিতরণের কাজ চলছে।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: আরিফুল ইসলাম জানান, চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপৎসীমার ৪০ সেন্টিমিটার ও সেতু পয়েন্টে ধরলার পানি বিপৎসীমার ৬২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
Leave a Reply