1. rkarimlalmonirhat@gmail.com : Rezaul Karim Manik : Rezaul Karim Manik
  2. maniklalrangpur@gmail.com : রংপুর সংবাদ : রংপুর সংবাদ
দৌড়ের ওপর জনগণ - রংপুর সংবাদ
বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০১:৪১ পূর্বাহ্ন

দৌড়ের ওপর জনগণ

সৈয়দ বোরহান কবীর
  • আপডেট সময় : শনিবার, ২৪ জুলাই, ২০২১
  • ৯৭ জন নিউজটি পড়েছেন

এবার ঈদুল আজহাটা হলো উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ ও শঙ্কার। ১৫ জুলাই থেকে ঈদের জন্য সবকিছু খুলে দেওয়া হয়েছিল। মানুষ গরুর হাটে গেল। বাসে, ট্রেনে, লঞ্চে যে যেভাবে পারল ছুটে গেল নাড়ির টানে। হাটে, মাঠে, ঘাটে মানুষ গিজগিজ। স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই। মাস্ক পরতেও যেন রাজি নয় বেশির ভাগ মানুষ। আগামী কদিন দেশের করোনা পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে এ আশঙ্কায় হাত-পা ঠান্ড হয়ে আসে। গত আট-১০ দিনের ঘটনা আমাকে একটি প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। মানুষ কথা শুনছে না কেন? জনগণকে বলা হচ্ছে ঘর থেকে বেরোলে যেন মাস্ক পরে। কিন্তু একটি বড় অংশ জনগণ মাস্ক পরাটাকেই যেন শাস্তি মনে করছে। স্বাস্থ্যবিধির কথা বলা হচ্ছে দেড় বছর ধরে। কিন্তু আমরা কজন মানছি স্বাস্থ্যবিধি? ঈদের আগে লক্ষ্য করলাম মানুষ কেমন যেন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। বাঙালি জাতি কি একটু আইন অমান্যে আগ্রহী? এমন প্রশ্ন করতেই নিজের ভিতর থেকে উত্তর এলো- না। এ বাঙালি জাতি একজন মহামানবের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। জাতির পিতা বলেছেন, দোকানপাট খুলবে না। জনগণ স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে দোকানপাট বন্ধ করে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, অফিস-আদালত বন্ধ। সবকিছু বন্ধ হয়েছে। ’৭১-এর মার্চে জাতির পিতা শেখ মুজিব যা বলেছেন মানুষ জীবন দিয়ে তা করেছে। কেউ বলেনি আমাদের প্রণোদনা লাগবে। কেউ বলেনি আমরা চলব কী করে। বঙ্গবন্ধুর কথায় নিরস্ত্র বাঙালি প্রতিরোধ করেছে। যুদ্ধ করে পরাজিত করেছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে। কাজেই বাঙালি অবাধ্য, তারা কথা শোনে না এমনটি নয়। নব্বই দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও এ দেশের রাজনৈতিক নেতাদের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে বেশির ভাগ মানুষ। জীবন দিয়েছে গণতন্ত্রের জন্য, মানবাধিকারের জন্য। সেই মানুষ এখন কথা শুনছে না কেন? আর এ কথাগুলো বলা হচ্ছে মানুষের মঙ্গলের জন্য। জনগণের ভালোর জন্য। কিন্তু মানুষ এসব কথা পাত্তাই দিল না। কেন?

একটু লক্ষ্য করবেন, বঙ্গবন্ধু মানুষের ওপর কর্তৃত্ব করে কোনো আদেশ দিতেন না। বঙ্গবন্ধু মানুষের পাশে থেকে নির্দেশনা দিতেন। জনগণ বঙ্গবন্ধুকে বিশ্বাস করত। বঙ্গবন্ধু মানুষকে সম্মানিত করতেন। মর্যাদা দিয়ে কথা বলতেন। ৭ মার্চের ভাষণের কথাই ধরা যাক। ৭ মার্চের ভাষণের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আজ দুঃখ ও ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন।’ বঙ্গবন্ধু জনগণকে প্রথমেই ক্ষমতায়ন করলেন। ‘আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন’ কথাটির মধ্য দিয়ে জনগণকে সম্মানিত করলেন। বঙ্গবন্ধু জনগণের ওপর কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেননি। জনগণকে আগে জাগিয়েছেন। জনগণও বুঝেছে, বিশ্বাস করেছে বঙ্গবন্ধু যা বলছেন তা মানুষের জন্যই। বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গ এখানে নিয়ে এলাম এজন্য যে সাধারণ মানুষকে আস্থায় নিয়ে যে কোনো আদেশ দিতে হয়। এমনভাবে কোনো নির্দেশনা দিতে হয় যা মানুষ বিশ্বাস করে। এমন ব্যক্তিরই আদেশ বা নির্দেশনা দেওয়া উচিত যাকে মানুষ ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে, বিশ্বাস করে। বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ যখন শুরু হলো তখন প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেন। জনগণকে করোনার ভয়াবহতা সম্পর্কে বললেন। আশ্বস্ত করলেন। সে সময় কিন্তু দেশের মানুষ প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনেছিলেন। গত বছর মার্চে দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর ‘সাধারণ ছুটি’ মানুষ মেনে নিয়েছিল। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা যখন শুরু হলো তখন এপ্রিলের ১৪ তারিখ থেকে লকডাউন জারি করা হলো অনেকটা ধমকের কায়দায়। লকডাউনের আগে থেকেই অবশ্য আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী দেশের জনগণকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ফেলেন। জানুয়ারিতে তিনি করোনা মোকাবিলায় সফল হয়েছেন বলে দাবি করেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, টিকা ছাড়াই নাকি দেশ থেকে করোনা চলে যাবে। তার কথায় উৎসাহিত হয়ে পর্যটন কেন্দ্রগুলো খুলে গেল। ওয়াজ মাহফিল, বিয়ের অনুষ্ঠানের ধুম পড়ে গেল। করোনাও মুচকি হাসল। না, টিকা ছাড়া করোনামুক্ত হয়নি বাংলাদেশ। তরতর করে করোনার গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী হলো। সুর পাল্টালেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। দায়ী করলেন দেশের জনগণকে। জনগণই করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধির জন্য দায়ী। জনপ্রশাসনমন্ত্রীর কথাবার্তার ধরন এমন যে পারলে জনগণকে পিটিয়ে চামড়া তুলে ফেলেন। এরপর আবিভর্‚ত হলো মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। জারি করা হলো একের পর এক ফরমান। এটা করা যাবে, এটা করা যাবে না। সীমিত আকারে অফিস চলবে, তবে গণপরিবহন চলবে না। তাহলে একটা ছোট চাকুরে, একজন পিয়ন কীভাবে তার কর্মস্থলে যাবেন। গত ঈদে (ঈদুল ফিতর) তো মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ জগাখিচুড়ির বিস্ময়কর রেকর্ড করল। গণপরিবহন বন্ধ করে দিল। কিন্তু বাঙালি জাতি যদি সিদ্ধান্ত নেয় কিছু একটা করবে তাহলে তাকে ঠেকানোর সাধ্য কার? জনস্রোতে মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখের চিত্র ফুটে উঠল। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রজ্ঞাপনগুলো কেউ যদি পর্যালোচনা করেন তাহলে দেখা যাবে এগুলো শুধু সমন্বয়হীন নয়, অমানবিক। এ যেন মানুষকে গিনিপিগ বানিয়ে নানা রকম এক্সপেরিমেন্ট। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কেন জাতির সঙ্গে এমন তামাশা করছে? কেন সামরিক ফরমানের কায়দায় প্রজ্ঞাপন জারি করছে? উত্তরটা পেতে একটু গভীরে যেতে হবে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের বড়কর্তা এখন দ্বিতীয় দফা চুক্তিতে। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ এবং ‘যেমন খুশি সাজ’ আমার কাছে একই মনে হয়। জবাবদিহি নেই, ক্যারিয়ারের চিন্তা নেই। কাজেই মন যা চায় তা করা যায়। তা ছাড়া ওই কর্তা নিয়োগ পেয়েছিলেন স্বৈরাচারের আমলে। ‘টিকচিহ্ন দেওয়া ব্যাচ’ বলে খ্যাত ওই ব্যাচকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে। উপজেলা চালু করার পর তড়িঘড়ি তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়। টিকচিহ্ন দিয়ে যারা বড়কর্তা তারা হয়তো প্রজ্ঞাপনও টিক দিয়েই অনুমোদন করেন। যাক সে প্রসঙ্গ। ১ জুলাই শুরু হলো কঠোর লকডাউন। নিরীহ দরিদ্র মানুষকে গ্রেফতার শুরু হলো। অনেক নিম্ন আয়ের মানুষকে জরিমানা করা হলো। গাড়িওয়ালা বড়লোকেরা দাঁত কেলিয়ে গাড়িতে ঘুরে বেড়াতে লাগল। এ যেন দারিদ্র্য নির্মূল কর্মসূচি। একপর্যায়ে এ লকডাউনও অচল হয়ে পড়ল। অবশেষে ঈদের আগে বাধ্য হয়ে আট দিন সবকিছু খুলে দেওয়া হলো। খুলে দেওয়ার পরপরই দেখলাম কর্তাব্যক্তিদের হুঙ্কার, ধমক আর কর্কশ কণ্ঠস্বর। একজন মন্ত্রী (প্রতিমন্ত্রী) বললেন, ‘স্বাস্থ্যবিধি না মানলে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।’ গার্মেন্ট ব্যবসায়ী থেকে মেয়র হওয়া এক ভাগ্যবান নগরকর্তার মুখে যেন সারাক্ষণ খই ফুটছে। তিনি যেন সুন্দর, নম্র, ভদ্র ভাষায় কথাই বলতে পারেন না। কোরবানির হাটে স্বাস্থ্যবিধি না মানলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে, হাট বন্ধ করে দেওয়া হবে। এই মেয়রের প্রধান কাজ জনগণকে ধমক দেওয়া এবং ভয় দেখানো। কখনো তিনি ডেঙ্গু নিয়ে জরিমানার ভয় দেখান, কখনো ধমক দেন। তবে ঈদের আগের দিন এক মন্তব্য করে ওই মেয়র সবাইকে স্তম্ভিত করে দিলেন। তিনি হুঙ্কার দিয়ে বললেন, ‘কোথাও, কারও বাসার সামনে বর্জ্য পড়ে থাকলে তা পরিষ্কার করব না। উল্টো সেই বাসার সামনে ট্রাকে করে বর্জ্য ফেলে দিয়ে আসব।’ একজন জনপ্রতিনিধি এ ধরনের উসকানিমূলক, দায়িত্বহীন মন্তব্য করেন কীভাবে। তার এ ধমক ও চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে আল কোরআনের সুরা লুকমানের একটি আয়াত মনে পড়ে। সুরা লুকমানের ১৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘পদচারণে মধ্যবর্তিতা অবলম্বন কর এবং কণ্ঠস্বর নিচু কর। নিঃসন্দেহে গাধার স্বরই সর্বপেক্ষা অপ্রীতিকর।’

ঈদের সময় দেখলাম সর্বত্র যেমন যানজট, তেমনি ক্ষমতাবানদের শব্দজট। একেকজন যেন শব্দবোমা ফোটাচ্ছেন জনগণের উদ্দেশে। প্রশ্ন হলো, আমাদের কর্তাব্যক্তিরা কি জনগণের শাসক না সেবক। শাসক হলে জেল-জরিমানা, ভয়ভীতি ইত্যাদি দেখাতেই পারেন। কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কি শাসক হওয়া সম্ভব? গণতান্ত্রিক সরকার হলো জনগণের সেবক। সরকারের প্রধান কাজ জনগণের জীবনযাত্রা স্বস্তিকর, স্বাভাবিক ও সুন্দর রাখা। সেবকরা জনগণকে আস্থায় নিয়ে, তাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে একেকটি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেন। আমাদের দেশে সরকারের কিছু ব্যক্তির মধ্যে সেবক ভাবটা নেই। তাদের মধ্যে একটা কর্তৃত্ববাদী মনোভাব এখন বেশ দৃশ্যমান। মনে হয় একটি চাবুক নিয়ে ঘুরছেন। সুযোগ পেলেই জনগণকে চাবকিয়ে দেবেন। কেন এমনটা? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে দুটি কারণ সামনে এলো। প্রথম কারণটা হলো দীর্ঘদিন দায়িত্বে থাকা। আওয়ামী লীগ টানা ১২ বছরের বেশি সরকারে। এ সময় সরকার বিনা চ্যালেঞ্জে দেশ চালাচ্ছে। বিরোধী দল না আছে রাজপথে না সংসদে। করোনার আগে ছোটখাটো যেসব চ্যালেঞ্জ এসেছে সেগুলো প্রধানমন্ত্রী একাই সামলেছেন। মন্ত্রী, কর্তাব্যক্তিরা ভাবনাহীন, কর্মহীন। এমন অনেক মন্ত্রী আছেন তারা জানেনই না দেশে কী হচ্ছে। ব্যাপারটা আমার মনে হয় এক ব্যক্তির উপার্জনের সংসারের মতো। যিনি উপার্জন করেন তিনি সারা দিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কষ্ট করেন। তার ছেলেমেয়েরা ঘুম থেকে উঠে ফেসবুক খোলে। কিছুটা হাওয়া খেতে যায় আর কাজের লোকজনকে কথায় কথায় ধমকায়। এরা চিন্তাও করে না সংসার কীভাবে চলছে। আওয়ামী লীগ সরকারের অবস্থাও অনেকটা তেমনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একা সব বিপদ সামলান। আর মন্ত্রী এবং পদস্থ কর্তারা হাওয়া খেয়ে ঘুরে বেড়ান। তাদের যেহেতু কাজ নেই তাই দেশের জনগণের ওপর মাঝেমধ্যে ক্ষমতার দাপট দেখান। আর টুকটাক দুর্নীতিতে জড়ান। জনগণের সঙ্গে সম্পর্কহীন মন্ত্রী ও চাটুকার আমলারা মনে করেন একটু ক্ষমতা না দেখালে কীসের মন্ত্রী, কীসের সচিব। ঈদের হুড়োহুড়ির মধ্যে দেখলাম স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিজ্ঞাপন দিয়ে জনগণকে নসিহত করেছেন। এটাকে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ফরমানও বলা যেতে পারে। ওই বিজ্ঞাপনে জনগণকে কী কী করতে হবে তা আদেশ করেছেন (অনুরোধ নয়)। মন্ত্রীর ছবিসংবলিত বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, পশুর হাটে কী কী করতে হবে।

কদিন আগেই (১২ জুলাই) স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাতিকে জানিয়ে দিলেন ‘করোনা ঠেকানো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়’। তাই যদি সত্যি হবে তাহলে ‘কোরবানির পশুর হাটে সতর্কতা বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী জাহিদ মালেক, এমপি মহোদয়ের আহ্‌বান’সংবলিত বিজ্ঞাপনটি কেন? এটা কি ‘মন্ত্রী মহোদয়ের’ ব্যক্তিগত প্রচারের জন্য? স্বাস্থ্যমন্ত্রী অবশ্য মাঝেমধ্যেই পত্রিকায় এবং টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনে মডেল হিসেবে হাজির হন। কদিন আগে তার শালীনতাহানি-সংক্রান্ত এক বিজ্ঞাপনও ছাপা হয়েছিল। এটি একটি উদাহরণ মাত্র। যখন একজন মানুষ কর্মহীন থাকেন তখন তিনি কিছু একটা করে দেখাতে চান। করে দেখানোর সহজ উপায় হলো কাউকে গালি দেওয়া, ধমক দেওয়া, ভয় দেখানো। এটা দীর্ঘদিন আলস্যজনিত রোগের লক্ষণ। কিছু মন্ত্রী এবং অধিকাংশ আমলার মধ্যে এটি দৃশ্যমান। কদিন আগে এক সচিবের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি একটি জেলার দায়িত্বে। সংসদে জেলার দায়িত্ব সচিবদের দেওয়া নিয়ে কিছুদিন আগে হুলুস্থুল হলো। এরপর আমি ওই আমলাকে জিজ্ঞেস করলাম আপনার দায়িত্ব যে জেলায় সেখানে কি যান? উনি উত্তরে বললেন ‘এ ডিজিটাল যুগে কি যাওয়া লাগে! টেলিফোনেই খবর নিই। ডিসির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করি।’ আমার আগ্রহ বেড়ে গেল। জিজ্ঞেস করলাম, ‘টেলিফোনে বলা নির্দেশ ডিসি মানেন?’ এ প্রশ্নে যেন আমলা খুব খুশি হলেন। দুলে উঠলেন চেয়ারে। বললেন ‘শোনে মানে! দৌড়ের ওপর থাকে।’ সচিব ডিসিকে দৌড়ের ওপর রাখেন। ডিসি অন্য কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ‘দৌড়ের ওপর রাখেন’। আর কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা জনগণকে দৌড়ের ওপর রাখেন। আমলাতান্ত্রিক ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির সবচেয়ে মূল্যবান ওষুধ হলো ‘ভয় ছড়িয়ে দাও’। ভয় ছড়িয়ে জয় কর- এ সংস্কৃতি এখন জনগণের ওপর প্রয়োগের চেষ্টা চলছে। আর এজন্যই বলা হয় ‘লকডাউন না মানলে কঠোর শাস্তি’। ‘হাটে স্বাস্থ্যবিধি না মানলে কঠোর শাস্তি।’ ইত্যাদি বাক্যে রীতিমতো দূষণ সৃষ্টি হয়েছে।

ধমক ও ভীতি সংস্কৃতির বিস্তারের দ্বিতীয় কারণ পেলাম বন্ধু নঈম নিজামের বাংলাদেশ প্রতিদিনের গত রবিবারের (১৮ জুলাই) লেখায়। ‘আমলাদের যুদ্ধটা কি রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে’ শিরোনামে লেখায় নঈম লিখেছেন, ‘সর্বনাশটা হয়েছে ২০১৮ সালের ভোটের কারণে। লাউ ডাল সব এক হয়ে গেছে।’ এ দুটি বাক্য আমার চিন্তার জট খুলে দিল। ভোটের জন্য একজন প্রার্থীকে জনগণের কাছে যেতে হয়। তাকে সম্মানিত করতে হয়। তার সঙ্গে নরম সুরে কথা বলতে হয়। ভোটারদের সমস্যাগুলো শুনতে হয়। সমস্যা সমাধানের জন্য কাজ করতে হয়। মাথায় সব সময় ভোটারদের মন রক্ষার চিন্তা থাকে। ভোটাররা একটু অসন্তুষ্ট হলেই সর্বনাশ। ২০১৮-এর নির্বাচনের পর আর এসবের বালাই নেই। জনগণ ভোট দিল কি দিল না সে খবর নেওয়ার দরকার নেই। কেন্দ্রে কেউ গেল কি গেল না তা-ও গুরুত্বপূর্ণ নয়। মনোনয়ন পেলেই বিজয় নিশ্চিত। এ বিজয়ের জন্য জনগণের কাছে কোনো কৃতজ্ঞতা নেই, দায়বদ্ধতাও নেই। কাজেই জনগণকে দৌড়ের ওপর রাখ। ২০১৮-এর ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর বাংলাদেশে যে ভোটগুলো হয়েছে তাতে জনগণ দর্শকমাত্র। ফলে ভোটবিহীন জনপ্রতিনিধি আর যোগ্যতাবিহীন আমলাদের এক যৌথ কর্তৃত্ব কায়েম হয়েছে। আগের লকডাউনের বিজ্ঞাপনের অসামঞ্জস্যতা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। গতকাল (২৩ জুলাই) যে লকডাউন শুরু হয়েছে তা নিয়ে একটি কথা শুধু বলতে চাই। ২১ জুলাই ঈদ হলো। অনেক মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে গ্রামের বাড়ি গেল ঈদ করতে। তাদের যদি ঢাকায় ফিরতে হয় তাহলে ২২ জুলাইর মধ্যেই ফিরতে হয়েছে। তারা কি খুশি হয়ে ফিরছেন? এ সিদ্ধান্ত যারা নিয়েছেন ফেরার পথে তাদের কি শাপ-শাপান্ত করেনি ভুক্তভোগী মানুষ? জনগণের ভোট পাওয়ার বিবেচনা মাথায় থাকলে এ রকম প্রজ্ঞাপন কোনো দিনই দেওয়া যেত না। ঈদের কেনাকাটার জন্য যদি আট দিন লকডাউন শিথিল করা যায় তাহলে ঢাকা বা কর্মস্থলে ফেরার জন্য শৈথিল্যের মেয়াদ এক দিন বা দুই দিন বাড়ালে কি মহাভারত অশুদ্ধ হতো। এসব আমলা করছেন জনগণের সঙ্গে সম্পর্কহীন থাকার কারণে। জনগণের কাছে তাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। আমলাদের হাঁকডাক দেখে বিনা ভোটে কিংবা ৪-৫ শতাংশ ভোট পেয়ে (তা-ও কি সঠিক?) জনপ্রতিনিধিরা নিশ্চুপ থাকেন কীভাবে, তারাও জনগণকে ক্ষমতা দেখানোর জন্য হুঁশিয়ার, সাবধান বলছেন। কিন্তু বাঙালি অদ্ভুত জাতি। এ জাতিকে আদর করে ভালোবেসে একটা অনুরোধ করলে সে অনুরোধ রক্ষার জন্য জীবন দিয়ে দেয়। আবার এ জাতিকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে একটি নির্দেশ দিলে তা অমান্য করার জন্যও রক্ত দেয়। জনগণকে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। মাস্ক পরা নিয়ে ঝামেলা শুধু বাংলাদেশ নয়, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের মতো দেশগুলো এ সমস্যা মোকাবিলা করছে। জার্মানিতে কদিন আগেও বিভিন্ন স্থানে ভলান্টিয়াররা মাস্কহীন মানুষকে একটা ফুল দিয়ে মাস্কটা পরিয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশে একটা সরকারি বিজ্ঞাপন দেখলাম, একজন দোকানদার ক্রেতাকে মাস্ক না পরার জন্য ধমক দিচ্ছেন। ধমক দিয়ে, জরিমানা করে মাস্ক পরানো যাবে না। ভয় দেখিয়ে লকডাউনও কার্যকর করা যাবে না। এসব কার্যকর করতে হলে জনগণের হৃদস্পন্দন শুনতে হবে। জনগণকে আপন করে নিতে হবে। জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে। জনগণকে দৌড়ের ওপর রেখে এ সমস্যার সমাধান হবে না। বাস্তবতা হলো, ১৪ এপ্রিল থেকে নানা প্রজ্ঞাপনে আর হুমিক-ধমকিতে জনগণ দৌড়ের ওপর। জনভোগান্তি আর বাড়াবেন না। বিএনপির যাত্রাবাড়ী এলাকার এক নেতা ২০০১-০৬ সালে জনগণকে দৌড়ের ওপর রাখত। কথায় কথায় জমি দখল, মামলা, জেল, অত্যাচার, ধমক, ভয় দেখানোই ছিল তার কাজ। প্রকাশ্যে ওই নেতা বলতেন ‘জনগণকে টাইটে রাখছি’। কিন্তু একদিন জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওই নেতাকেই ধাওয়া করল। এবার তিনিই দৌড়ে পালালেন। এরপর তার নামের আগেই ‘দৌড়’ শব্দটা যুক্ত হলো। ঘটনাটি সবাই জানে। কিন্তু এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য কজন বোঝে।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

ইমেইল : poriprekkhit@yahoo.com

আপনার সোস্যাল মিডিয়ায় শেয়ার দিন

Leave a Reply

এই ক্যাটাগরীর আরো সংবাদ

© ২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | রংপুর সংবাদ.কম
Theme Customization By NewsSun